বাংলাদেশে রাজনৈতিক আলোচনা মানেই আমরা দেখি মানুষ তাদের পছন্দের দল বা নেতার পক্ষে একেবারে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই কখনো চিন্তা করে না—এই সিদ্ধান্তটা আসলেই সবার জন্য ভালো কিনা, দেশের জন্য উপকারী কিনা। নেতার কথাই যেন শেষ কথা। এই মানসিকতাকে আমরা বাংলায় “গোলামী” বলি —মানে স্বাধীন হয়েও মনের দিক থেকে অন্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ এর আগে
আমাদের এই মানসিকতার শিকড় খুঁজতে গেলে যেতে হবে ইতিহাসে।
- প্রায় ২০০ বছর আমরা ছিলাম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে।
- তখন সাধারণ মানুষের হাতে শিক্ষা ছিল সীমিত। খবর, রাজনীতি বা মতামত জানার সুযোগ ছিল না।
- মানুষ ছিল জমিদার, স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ব্রিটিশ প্রশাসকের কথার উপর নির্ভরশীল।
- ভয়, অনিশ্চয়তা আর বঞ্চনা মানুষকে এমন করে তুলেছিল যে তারা প্রশ্ন না করে শুধু মেনে চলতো।
তবে একই সময়ে বুদ্ধিজীবী, কবি, চিন্তাবিদ যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম—তারা মানুষকে স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আন্দোলনও সেই চেতনা থেকেই জন্ম নেয়।
স্বাধীনতার পরেও কেন বদলায়নি মানসিকতা
১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান শাসনকাল এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা দিলেও, অন্ধ আনুগত্যের সংস্কৃতি পুরোপুরি পাল্টায়নি।
- শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো সমালোচনামূলক চিন্তার অভাব।
- রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিনির্ভর—দল মানেই নেতা, আর নেতা মানেই সব ঠিক।
- অনেক সময় মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরপেক্ষ খবরের অভাব থাকে, বরং একপেশে প্রচারণা (propaganda) ছড়িয়ে পড়ে।
ফলাফল: মানুষ অনেক সময় বুঝেই না যে তারা কাকে সমর্থন করছে, কী সমর্থন করছে।
অন্ধ আনুগত্যের ক্ষতিকর দিক
- গণতন্ত্র দুর্বল হয় – নেতা বা দল ভুল করলেও কেউ প্রশ্ন করে না।
- দুর্নীতি বাড়ে – কারণ জবাবদিহিতা নেই।
- সমাজ বিভক্ত হয় – দুই দলের সমর্থক একে অপরকে ঘৃণা করতে শুরু করে।
- সঠিক সিদ্ধান্ত হয় না – কারণ মানুষ আবেগ দিয়ে ভোট দেয়, তথ্য দিয়ে না।
কেন সচেতন নাগরিক হওয়া জরুরি
একজন সচেতন নাগরিক:
- নেতাকে ভালোবাসে কিন্তু প্রশ্ন করতেও ভয় পায় না।
- নিজের ও দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়।
- তথ্য যাচাই করে তারপর মতামত দেয়।
- পরবর্তী প্রজন্মকে বিবেচনা আর যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখায়।
এটাই আসল গণতন্ত্র—যেখানে নেতা জনগণের সেবক, আর জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় কী ঠিক, কী ভুল।
কীভাবে আমরা বদলাতে পারি
- শিক্ষা ও জ্ঞান বৃদ্ধি করুন
বই পড়ুন, খবর পড়ুন, ইতিহাস জানুন। - তথ্য যাচাই করুন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু দেখলেই বিশ্বাস করবেন না। - আলোচনা ও বিতর্ক করুন
বন্ধু, পরিবারে খোলামেলা কথা বলুন—ভিন্নমত শুনুন। - প্রশ্ন করুন
নেতা বা দল যা বলে, তার যুক্তি খুঁজুন। - সমালোচনা গ্রহণ করুন
ভিন্ন মতকে শত্রু ভাববেন না—এটাই শেখার সুযোগ।
আমরা স্বাধীন দেশ। এখন সময় এসেছে মনের স্বাধীনতা অর্জনের। অন্ধ আনুগত্য ছেড়ে যুক্তির পথে হাঁটলে, তখনই আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে, সমাজ উন্নত হবে। নেতা বা দলকে ভালোবাসুন, কিন্তু প্রশ্ন করতে ভুলবেন না। কারণ দেশের মালিক আমরা জনগণ, নেতা নয়।